Saturday, 14 January 2017

কাছে আসার গল্প

খেলাধুলা,বন্ধুদ
ের সাথে আড্ডা আর টুকটাক পড়াশুনা এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি।ছেলেটা পড়াশুনায় ছিল চরম ফাকিবাজ।একটুও বাড়িয়ে বলছি না কারণ অতীত রেকর্ড সে কথাই বলে ।ছোটবেলা থেকেই শান্তশিষ্ট তবে লেজবিশিষ্ট । কোনো কিছুতেই তার সিরিয়াসনেস বেপারটা ছিল বলে মনে হয় না,তা না হলে কি প্রাইভেট,কোচিং বাদ দিয়ে খেলার মাঠে পরে থাকে !এতক্ষণে পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কোন ছেলেটির কথা বলছি।

এইভাবেই দেখতে দেখতে চলে গেল দিনগুলি ।এস এস সি পরীক্ষা দরজায় কড়ানাড়া শুরু করলো ।আগের রেজাল্ট সম্পর্কে না হয় নাই বললাম !টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল ও হতাশার কিঞ্চিত ওপরে । বাকি আছে তিন মাস হঠাত করেই কেন জানি একটা দুশ্চিন্তা এসে ভর করলো ।সবসময় আম্মার মায়ামাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠত ।চিন্তা করতাম কি করে সহ্য করব এই চোখের কান্না !এমনিতেই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি এই অসম্ভব রকম ভদ্র মহিলাকে।আমার বাবাও আবার জীবিকার তাগিদে দেশ থেকে অনেক দূরে।কি বা জবাব দিবো বজ্রকঠিন বাবাকে ?আর ভাবতে পারলাম না ,মনে মনে স্থির করলাম সব বাদ দিয়ে দিব । at least চেষ্ঠাটা তো করি! যেই কথা সেই কাজ ।আমার খাটুনি আর আম্মার দোয়া সব কিছুরই যেন টাইমিং মিলে গেল ।আল্লাহ ও নিরাশ করেননি ।তারপর আমার বাবা মায়ের খুশি আর কে দেখে!সংগত কারণেই আমাকে আমার শহরের একটা কলেজে admission নিতে হলো ।সিরিয়াস পড়াশোনা না করলেও তখন মোটামুটি একটা flow তে থাকায় তেমন সমস্যা হয় নাই,রেজাল্ট ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম । UCC এর ফার্মগেটস্থ শাখায় কোচিং করা সত্তেও নানাবিদ কারণে কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি ।বাবা মার চাপে বাধ্য হয়েই admit হতে হলো BRAC University তে ।শুরু হয়ে যায় নতুন করে পথ চলা । এতসব কিছুর ভিড়ে ভালবাসা নামে যে কিছু একটা আছে তা ভুলেই গিয়েছিলাম ।এতদিন যেহেতু হয়নি ধরেই নিয়েছিলাম আর বুঝি এসব আমার দ্বারা হবে না ।দেখতে দেখতে ফার্স্ট সেমিস্টারের মাঝামাঝি চলে এলাম ।দিনটা ছিল এ বছরের একুশে ফেব্রুয়ারী।একটা ছুটির দিন মানে এখন সোনার হরিণ হাতে পাওয়া !সারাটা দিন ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করলাম । মনটা ভালো ছিলো না তাই সন্ধায় মিশুকে ফোন দিলাম ।

মিশু ,অনন্যা ,নিশাত ,মার্জিয়া ,পৃথা ,প্রিনন,অন্তরা সবাই আমার জানেজিগরী দোস্ত ।এদের নিয়ে ফেলে আসা দিনগুলো মাঝে মাঝেই বেশ স্মৃতিকাতর করে দেয়,তাছাড়া ইদানিং হোম সিকনেসটা ভালই ভুগাচ্ছে ।তাই যখন মনটা খারাপ লাগে তখন এদের কোন একজনের সাথে কথা বলে নিজেকে হালকা করার চেষ্ঠা করি ।যাই হোক,সে আরও অনেক কথা ।যা বলছিলাম,ঐদিন সন্ধায় যখন মিশুর সাথে ফোনে নানা ফাজলামিতে ব্যস্ত তখন হঠাতই শোনতে পেলাম ফোনের ওপাশ থেকে কে যেন গান গাইছে !পাঠকরা হয়তো ভাবছেন মিশু গান গাইছে !ছি...ও খুব সুন্দর করে চাপা মারতে পারলেও এই কাজটা পারে না ।আমি সাথে সাথে ওকে বললাম ওই শয়তান আর একটা কথাও বলবি না ,গানটা শুনতে দে ।মিশু ও বাধ্য মেয়ের মত চুপ করলো আর ফোনটা গানের উৎসের আরো কাছে নিয়ে গেল ।আমি নির্বাক চিত্তে পুরোটা গান মনোযোগ দিয়ে শুনলাম ।এই প্রথম খালি গলায় এত সুন্দর সুরে কাউকে গাইতে শুনলাম । তারপর মিশু জিজ্ঞাস করলো কিরে কেমন লাগলো ?তখন আমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজেই জানি না ,উত্তরে মনের অজান্তেই বলে দিলাম প্রেমে পরে গেছি ।এই কথাটা আবার মিশু সেই সুরেলা কন্ঠের অধিকারিনী কে বলে দিল ।মিশুর সাথে আমার কথা তখন ও চলেই যাচ্ছিল ।কথার এক পর্যায়ে কখন যে ওই অপরিচিতা ফোনটা কেড়ে নিল আমি বুঝতেই পারি নি ।গর্ধবের মত মিশু ভেবে তার সাথে ১৫ মিনিট কথা বললাম ।সেদিন অনেক মজা করলাম আর মেয়েটা আমার সব দুষ্টামির খুরাক জুগিয়েছে । মেয়েটা ঐদিন দুষ্টামির এক পর্যায়ে আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে মিশুর এক দুর্লভ প্রশ্নের উত্তরে বলে তার আর আমার তিন বছরের রিলেশান ,অনেকদিন পর আমাদের কথা হচ্ছেতো তাই আমরা এইভাবে কথা বলছি আরো কত কি! হঠাত করেই মেয়েটা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে যায় আর খানিকটা অপরাধী কন্ঠে বলে উঠে কিছু মনে করবেন না একটু ফান করলাম আর কি sorry ।আমি আর কি বলব!তখন নিজেকে গাধা ছাড়া বেশি কিছু মনে হচ্ছিলো না।সেদিনই জানতে পারলাম মেয়েটার নাম সুমাইয়া ।নর্দান ইউনিভার্সিটিতে এল.এল.বি পরছে ।মিশু আর ও একসাথেই থাকে ।ফোন রাখার পর কি মনে করে যেন ফেসবুক এ মিশুর ফ্রেন্ড লিস্ট ঘেটে মেয়েটাকে বের করলাম ।আইডিটা নতুন তাই হয়ত বোকা মেয়েটা কিছু না বুঝেই নিজের ছবি প্রোফাইল পিকচার দিয়েছে ।তার মায়াবী চোখ গুলার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ।মনে হয় তখনই সিরিয়াস রকম crush খাইছিলাম ।

তার ঠিক ২দিন পর মিশু ফোন দিয়ে বলল দোস্ত ফ্রি আছিস ? আজ বিকালে আমার হোস্টেল এর সামনে এসে পর একটু নিউ মার্কেট যাব ।সময় কাটছিল না তাই ভাবলাম একটু ঘুরেই আসি ।সাথে নিশাত ও ছিল । অনেকক্ষণ দাড়ায়ে থাকার পর মিশু বের হলো ,ওর পিছনে দেখি আরেকজন অপরিচিতা ।নিষ্পাপ চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বারবার মনে করার চেষ্ঠা করছিলাম কিন্তু আমার স্মৃতি প্রতিবারই আমার সাথে প্রতারণা করছিল ।ঠিক এমন সময় মিশু কানেকানে বলে দিল এইটা সুমাইয়া ।আমি এমন একটা ভাব নিলাম যে মিশুকেই ভালোভাবে চিনি না ,কিছুটা লজ্জাও লাগতেছিল বটে।আমি কিছু না বুঝে মিশুকে বললাম ওই লজ্জা পাচ্ছিস কেন ?মিশু আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো কথাটা কাকে বলছে বুঝছিস তো সুমাইয়া ?দেখছেন ওকে কি আমি বিনা কারণে শয়তান বলি ?অবশেষে সব তর্ক পিছনে ফেলে গেলাম নিউ মার্কেট। এর মধ্যে কয়েকবার সুমাইয়ার সাথে আমার চোখাচোখি ও হয়ে গেল,সাথে নিশাত আর মিশুর পেরা তো ছিলই । মেয়েটা মনে মনে কি ভেবেছে কে জানে !তবে ও যে লজ্জা পেয়েছে এই বেপারে কোনো সন্দেহ নেই।নিউ মার্কেট এর কাজ একটু আগেই শেষ হয়ে গেল ।সবাই ভাবছিল কোথায় যাওয়া যায় ?আমি বলে উঠলাম চল টি এস সি তে যাই ।সুমাইয়ার সাথে ঐদিন ফোনে দুষ্টামি করে বলেছিলাম আমরা টি এস সি তে দেখা করব ।কাকতালীয় ভাবে সেটাই সত্যি হয়ে গেল ।সুমাইয়া ও দেখলাম অনেকটা অবাক হলো ।বাসায় আসতে আসতে সন্ধা হয়ে গেল ।অনেক চিন্তা ভাবনার পর সুমাইয়াকে ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠাব বলে ঠিক করলাম।ওর আইডি তে ক্লিক করতেই দেখি respond to friend request !আমার তো আকাশের চাদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা !তার বেশ কিছুদিন পর ছিল আবার নিশাতের জন্মদিন ।তো যথারিতি সেখানে গেলাম ।লজ্জার মাথা খেয়ে মিশুকে বলে রেখেছিলাম যেন সুমাইয়া কে সাথে নিয়ে যায় ।শয়তানটা প্রথমে আমাকে না করলেও পরে ঠিকই চমকে দিয়েছিল। অনেক ঘুরাঘুরির পর বসুন্ধরায় গেলাম কিছু খেয়ে নিশাতকে ধন্য করার জন্য ।

বন্ধুরা মজা নেয়ার জন্য নিশাতকে দেয়া ফুল আমাকে ধরিয়ে দিয়ে সুমাইয়ার সামনেই বলে ওকে দেয়ার জন্য ,যদিও সবই ছিল ফাজলামি তবু ও কেমন যেন লাগছিল !অবশেষে মানসম্মান রক্ষার্থে নিজের চেষ্ঠার সর্ব্বোচ্চ প্রয়োগ করলাম ।এখানেই শেষ হলে তো ভালই ছিল কিন্তু পরে যা হলো !

শয়তান গুলা সুমাইয়ার গালে কেক এর ক্রিম লাগিয়ে দিয়ে আমাকে বলল মুছতে !আমি তো পুরা শেষ !ওরা কেউ তো এগিয়ে আসছেই না বরং বেচারীকে নিজের হাতেও মুছতে দিচ্ছে না ।মুখে লজ্জার লালবর্ণ মিশ্রিত মিষ্টি হাসি লাগিয়ে বেচারী আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ।কি আর করা !অবশেষে চোখ বন্ধ করে মুছে দিলাম ।কপালটা ভালো সুমাইয়া মাইন্ড করে নাই ।ও বেপারটাকে ফ্রেন্ডলি ভাবেই নিয়েছিল ।ঐদিন রাতেই অজানা নাম্বার থেকে একটা এস এম এস আসে 'আজকে কার সাথে এত ঘুরাঘুরি করলেন ?'আমি দুষ্টমি করেই রিপ্লাই দিলাম কেন আমার বউ এর সাথে ।কোনো এস এম এস আসে না দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ।সুমাইয়া কি না শিওর হবার জন্য কল দিলাম ।৩য় বার কল রিসিভ করলো ।শুরু হয় ফোনালাপ।আমরা আমাদের টুকটাক সব কিছুই শেয়ার করতাম।আস্তে আস্তে সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসল,অপরিচিতা থেকে খুব কাছের একজন মনে হতে লাগলো । জানতে পারলাম প্রেম ভালবাসার প্রতি ওর চরম বিরক্তির কথা ।এই বেপারে কোনো ছেলেকেই সে বিশ্বাস করে না এবং নিজের দিক থেকে যথেষ্ট যুক্তি ও দেখায় ।আমি ওকে কিছু বলি না ।এভাবেই চলে যায় অনেকগুলা দিন ।প্রতিদিন ওর কথা ভাবতাম আর কিভাবে প্রপোস করব তার নকশা আকঁতাম ।ওর উত্তরটা কি হতে পারে সেটা ভেবে থমকে যেতাম তবু কেন যেন মনের কোনে একটু আশা লুকিয়ে থাকতো !আমরা প্রায়ই দেখা করতাম।আমি সবসময় পাগলিটার জন্য তার প্রিয় পার্ক চকলেট নিয়ে যেতাম।এটা পেয়ে ও যে কি খুশি হত তা বলে বুঝাতে পারব না !তার হাসির শব্দে আমি আনমনে হয়ে যেতাম । মেয়েটা খাওয়া দাওয়ার বেপারে সবসময় উদাসীন ।এইতো একদিন তার হোমটাউন রাজবাড়ী থেকে না খেয়ে চলে আসে ,একে তো লম্বা journey করে এসেছে আবার বলে দুপুরেও খাবে না ।কারণ হোস্টেলে এসে দেখে তার রান্না দেয়া হয় নাই ।ঐদিন আমি ওকে অনেকটা জোর করেই নিয়ে খাওয়াই ।এর জন্য যে কত কিছু করতে হয়েছে !এইরকম ছোটখাটো বেপারগুলা কিভাবে যেন আমার চোখ এড়াতে পারতো না ।এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। ওই দিনটা ছিল ৪ এপ্রিল,সুমাইয়ার সাথে বিকালে দেখা করতে যাওয়ার কথা।সুমাইয়াই বলেছিল যেন ৩টা বাজার ঠিক ১০ মিনিট আগে উপস্থিত থাকি।কিন্তু ঢাকা সিটির সেই চিরচেনা জ্যামের কাছে হার মেনে ঠিক সময় মত পৌছাতে ব্যর্থ হলাম ।আর তার কি রাগ !সেজান পয়েন্টে ওর প্রিয় ফুচকা খেলাম তবু রাগ কমে না।তারপর জিয়া উদ্যান গেলাম।আমি একাই পাগলের মত বকবক করতে লাগলাম হঠাৎ আমার দিকে এমন একটা চাহনী দিল আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম !হাসতে হাসতে বলে উঠলাম তুমি রাগলে তোমাকে আরো সুন্দর দেখায় ।মনে হলো আগুনে পানি ঢালার পরিবর্তে কেরোসিন ঢেলে দিলাম !সবশেষে উপায় না পেয়ে পার্ক চকলেট এর শরণাপন্ন হলাম ।ওকে লুকিয়ে চকলেট টা ওর পাশে রাখলাম।কিছুক্ষণ পর আচমকা চিত্কারে আমার বুক কেঁপে উঠল।বুঝতেই পারছেন !ঐদিন অনেক কথা হলো,হটাৎ আবিষ্কার করলাম ও আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।আমি ওর চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে ওকে চিন্তার জগৎ থেকে মুক্তি দিলাম।এইবার ওঠার পালা,হেঁটে চললাম সুমাইয়ার হোস্টেলের দিকে।যাওয়ার পথে ফার্মগেট রেস্টুরেন্ট থেকে চা খেলাম।এখানকার চা নাকি ওর অনেক ভালো লাগে ।অবশেষে ওর হোস্টেলের সামনে গেলাম ,ঐখানে একটা দোকানে ঢুকলাম।অনেকগুলো কলম দেখিয়ে আমাকে বলল কোনটা পছন্দ ?একটা choose করলাম।তারপর বলল একটু বাইরে গিয়ে দাড়াও,আমি আসছি। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে আসল ।আমাকে চোখ বন্ধ করতে বলল।আমি চোখ বন্ধ করলাম,বুঝতে পারছি আমার হাতে কিছু দিচ্ছে !হঠাৎ কানের পাশে আস্তে করে কিছু ইংরেজি শব্দ শুনলাম ,যেগুলো এক করলে দাড়ায় আই লাভ ইউ ।তখন ও আমার চোখ বন্ধ ।সবকিছু কেমন হিব্রু হিব্রু লাগছে !আর কোনো শব্দ শুনতে না পেয়ে খানিকপর চোখ খুলে দেখি হাতে সেই কলম আর একটা সাফারী ধরিয়ে পাগলীটা এক দৌড়ে হোস্টেলে চলে গেলো !আমি তো একদম ভেবাছেকা খেয়ে গেলাম।বোকার মত একই পোজে ৩০মিনিট দাড়িয়ে ছিলাম ।কলম দেয়ার কারণ অবশ্য পরে ব্যাখ্যা করেছিল ।সেটা না হয় নাই বললাম ।এখানেই শুরু।বাকিটা পথ এই পাগলিটাকে সাথে নিয়েই চলতে চাই:)।

গল্পটা উৎসর্গ করলাম আমার সে সকল বন্ধুদের ।তোদের অনেক মিস করি দোস্ত ।ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।ভালো থাকবেন ।

No comments:

Post a Comment